এই লেখায় যা যা আছে
সূরা নাস
সূরা নাস (সূরা আন-নাস, আরবিতে: سورة الناس; মানবজাতি) মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের ১১৪ তম এবং সর্বশেষ সূ্রা।
এর আয়াত, অর্থাৎ বাক্য সংখ্যা ৬ এবং রূকু, অর্থাৎ অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১। সূরা আন-নাস মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছিলো; যদিও কোন কোন বর্ণনায় একে মক্কায় অবতীর্ণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর ৬ আয়াতে শয়তানের ক্ষতি থেকে সুরক্ষার জন্য সংক্ষেপে আল্লাহর নিকট প্রার্থণা করা হয়।
এই সূরা নাস এবং এর পূর্ববর্তী সূরা আল-ফালাককে একত্রে মু’আওবিযাতাইন (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য দু’টি সূরা) নামে উল্লেখ করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় বা ঘুমের আগে এই সূরাটি পড়া একটি ঐতিহ্যগত সুন্নত।
সূরা নাস এর নামকরণ

সূরা আন-নাস ও সূরা আল-ফালাক আলাদা আলাদা সূরা হলেও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক গভীর ও উভয়ের বিষয়বস্তু পরস্পরের সাথে এত বেশি নিকট সম্পর্কিত যে এদেরকে একত্রে “মু’আওবিযাতাইন” (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য দু’টি সূরা) নামে ডাকা হয়; আর এই সূরা দু’টি নাযিলও হয়েছে একই সাথে একই ঘটনার পরি-প্রেক্ষিতে।
সূরা নাস এর শানে নুযুল
সূরা ফালাক এবং পরবর্তী সূরা আন নাস একই সাথে একই ঘটনায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত রয়েছে, জনৈক ইহু্দী রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)- এর উপর জাদু করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জিবরাঈল আগমন করে সংবাদ দি্যেছিলেন যে, জনৈক ইহু্দী জাদু করেছে এবং যে জিনিসে জাদু করা হয়েছে, তা একটি কুপের মধ্যে আছে।
রাসূলুল্লাহ্ লোক পাঠিয়ে সেই জিনিস কূপ থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। তাতে কয়েকটি গিঁট ছিল। তিনি এই সূরা দুটি পড়ে ফুক দেওয়ায় গিঁটগুলো সাথে সাথে খুলে যায় এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শয্যা ত্যাগ করেছিলেন।
হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ্ এর উপর জাদু করলে সেটার প্রভাবে তিনি মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং যে কাজটি করেননি, তাও করেছেন বলে অনুভব করতেন। একদিন তিনি হযরত আয়েশা -কে বললেন,”আমার রোগটা কি, আল্লাহ্ তা’আলা তা আমাকে বলে দিয়েছেন। (স্বপ্নে) দুই ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং একজন শিয়রের কাছে ও অন্যজন পায়ের কাছে বসে গেল।”
শিয়রের কাছে উপবিষ্ট ব্যক্তি অন্য জনকে বলল,”তাঁর অসুখটা কি?”
অন্যজন বলল,”ইনি জাদুগ্রস্ত।”
প্রথম ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল,”কে জাদু করেছে?”
উত্তর হল, ইহুদীদের মিত্র মুনাফিক লবীদ ইবনে আ’সাম জাদু করেছে।
আবার প্রশ্ন হল,”কি বস্তুতে জাদু করেছে?”
উত্তর হল, একটি চিরুনীতে।
আবার প্রশ্ন হল,”চিরুনীটি কোথায়?”
উত্তর হল, খেজুর ফলের আবরণীতে ‘বির যরোয়ান’ কূপে একটি পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ তিনি কূপে গেলেন এবং বললেনঃ স্বপ্নে আমাকে এই কূপই দেখানো হয়েছে।
তারপর চিরুনীটি সেখান থেকে বের করে আনলেন।
সূরা নাস কোথায় অবতীর্ণ হয়

সূরা নাস মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে; যদিও কোন কোন বর্ণনায় একে মক্কায় অবতীর্ণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর ৬ আয়াতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার জন্য সংক্ষেপে আল্লাহর নিকট প্রার্থণা করা হয়।
সূরা নাস এর বাংলা অর্থসহ আয়াতসমূহ
সূরার নামঃ সূরা আন-নাস
শ্রেণীঃ মাদানী সূরা (মদীনায় অবতীর্ণ)
অন্য নামঃ মানুষ
নামের অর্থঃ মানবজাতি
সূরার ক্রমঃ ১১৪
আয়াতের সংখ্যাঃ ৬
রুকুর সংখ্যাঃ ১
পারার ক্রমঃ ৩০ পারা
শব্দঃ ২০
বর্ণঃ ৮০
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
কুল আউযু বিরাব্বিন নাস
বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি মানুষের পালনকর্তার,
مَلِكِ النَّاسِ
মালিকিন্ নাস
মানুষের অধিপতির ।
إِلَهِ النَّاسِ
ইলাহিন্ নাস
মানুষের মা’বুদের ।
مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
মিন্ শররিল ওয়াস্ ওয়াসিল খান্নাস
তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে,
الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
আল্লাযী ইউওযাসবিসু ফী ছুদুরিন্নাস
যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে ।
مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ
মিনা জিন্নাতি ওয়ান্নাস
জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে ।
সূরা নাস বাংলা উচ্চারণ ছবি

সূরা নাস তেলাওয়াত
কুল আ‘ঊযুবিরাব্বিন্না-ছ,
মালিকিন্না-ছ,
ইলা-হিন্না-ছ।
মিন শাররিল ওয়াছ ওয়া-ছিল খান্না-ছ।
আল্লাযী ইউওয়াছবিছুফী সুদূরিন্নাছ-।
মিনাল জিন্নাতি ওয়ান্নাছ।
সূরা নাস এর ফজিলত ও হাদিস
আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসায়ীর এক দীর্ঘ রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ বলেন,
যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বিভিন্ন বালা-মুসীবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট হয়। – (ইবনে-কাসীর)
সহীহ মুসলিমে ওকবা ইবনে আমের -এর বর্ণিত হাদীসে রসূলুল্লাহ বলেন,
তোমরা লক্ষ্য করেছ কি, অদ্য রাত্রিতে আল্লাহ তাআলা আমার প্রতি এমন আয়াত নাযিল করেছেন, যার সমতুল্য আয়াত দেখা যায় না। অর্থাৎ ক্বুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক এবং ক্বুল আউযু বিরাব্বিল নাস আয়াতসমূহ। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, তওরাত, ইঞ্জীল, যাবুর এবং কোরআনেও অনুরূপ অন্য কোন সূরা নেই।
এক সফরে রসূলুল্লাহ ওকবা ইবনে আমেনকে সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পাঠ করালেন, অতঃপর মাগরিবের নামাযে এ সূরা দুটি তেলাওয়াত করে বললেন,
এই সূরাদ্বয় নিদ্রা যাওয়ার সময় এবং নিদ্রা শেষে বিছানা থেকে উঠার সময়ও পাঠ করো। অন্য একটি হাদীসে তিনি প্রত্যেক নামাযের পর সূরাদ্বয় পাঠ করার আদেশ করেছেন। – (আবু দাউদ, নাসায়ী)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হাবীব বর্ণনা করেন,
এক রাত্রিতে বৃষ্টি ও ভীষণ অন্ধকার ছিল। আমরা রসূলুল্লাহ -কে খুঁজতে বের হলাম। যাখন তাকে পেলাম, তখন প্রথমেই তিনি বললেনঃ বল। আমি আরয করলাম, কি বলব? তিনি বললেনঃ সূরা এখলাস ও কূল আউযু সূরাদ্বয়। সকাল-সন্ধ্যায় এগুলো তিন বার পাঠ করলে তুমি প্রত্যেক কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। – (মাযহারী)
সূরা নাস এর তাফসীর

এ সূরায় মহা মহিমান্বিত আল্লাহর ৩ টি গুণ বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি হলেন পালনকর্তা, শাহানশাহ এবং মা’বুদ বা পূজনীয়। সব কিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন, সবই তার অধীন এবং সবাই তার আনুগত্য করছে।
তিনি তার প্রিয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন,
”হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির এবং মানুষের মা’বুদের, পশ্চাদ অনুসরণকারীর অনিষ্ট হতে যে মানুষের অন্তরসমূহে কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা দিয়ে থাকে। চাই সে জ্বিন হোক অথবা মানুষ হোক।”
অর্থাৎ যারা অন্যায় ও খারাপ কাজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে চোখের সামনে হাজির করে পথভ্রষ্ট এবং বিভ্রান্ত করার কাজে যারা অতুলনীয়। আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই শুধু তাদের অনিষ্ট হতে রক্ষা পেতে পারে।
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেন,“তোমাদের প্রত্যেকের সাথে একজন করে শয়তান রয়েছে।”
সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন,“হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার সাথেও কি শয়তান রয়েছে?”
উত্তরে তিনি বললেন,
“হ্যা আমার সঙ্গেও শয়তান রয়েছে? কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঐ শয়তানের মুকাবেলায় আমাকে সাহায্য করেছেন, কাজেই আমি নিরাপদ থাকি। সে আমাকে পুণ্য ও কল্যাণের শিক্ষা দেয়।”
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ই’তেকাফে থাকা অবস্থায় উম্মুল মু’মিনীন হযরত সফিয়া (রাঃ) তাঁর সাথে রাতের বেলায় দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে যাবার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)ও তাঁকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকেন।
পথে দু’জন আনসারীর সাথে দেখা হলো। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে তার স্ত্রীকে দেখে দ্রুতগতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁদেরকে থামালেন এবং বললেন,
“জেনে রেখো যে, আমার সাথে যে মহিলাটি রয়েছে এটা আমার স্ত্রী সফিয়া বিনতে হুইয়াই (রাঃ)।”
তখন আনসারী দু’জন বললেন,“আল্লাহ্ পবিত্র। হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)। এ কথা আমাদেরকে বলার প্রয়োজনই বা কি ছিল?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ
“মানুষের রক্ত। প্রবাহের স্থানে শয়তান ঘোরাফেরা করে থাকে। সুতরাং আমি আশংকা করছিলাম যে, শয়তান তোমাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় না কি।”
আমাদের আরো ব্লগ পড়ুন