এই লেখায় যা যা আছে
বিসিএস কি?
বিসিএস এর পূর্ণরুপ হলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস। এটা বাংলাদেশ সরকারের সিভিল সার্ভিস। এর আগের নাম ছিলো সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস অব পাকিস্তান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এটা সিভিল সার্ভিস হিসেবে পরিচিত হয়।
এটা উপনিবেশিক শাসনামলের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এর উত্তরসূরি ছিলো। এটা বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন দ্বারা নির্ধারিত। এর ক্যাডার সংখ্যা ২৬ টি। এরমধ্যে ১৪ টি সাধারণ এবং ১২ কারিগরি/পেশাগত ক্যাডার।
বিসিএস এর ইতিহাস
বিসিএস এর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ব্রিটিশরা আইপিএস বা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্টির শাসন করতো। আর আইপিএস এর বেশিরভাগ কর্মকর্তা ছিলেন ব্রিটিশ। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ভারতীয়রাও ব্রিটিশদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে।

‘৪৭ এর দেশভাগের সময় পাকিস্তানে ‘সেন্ট্রাল সুপেরিয়র সার্ভিসেস’ শব্দটিকে ব্যবহার করা শুরু করে। ‘৭১ এ বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এর একটা আইনের দ্বারা দেশের সরকার ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস গঠিত হয়।
২০১৮ সালে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয় ইকোনমিক ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত করে গ্যাজেট প্রকাশ করে। তখন বিসিএস ক্যাডারের সংখ্যা ২৭ থেকে নেমে ২৬ টি হয়ে যায়।
বিসিএস ক্যাডার লিস্ট

সর্বমোট ২৬ টি ক্যাডার আছে। যার মধ্যে সাধারণ ক্যাডার ১৪ টি এবং কারিগরি/পেশাগত ক্যাডার ১২ টি। নিচে এগুলোর লিস্ট দেয়া হলো,
বিসিএস সাধারণ ক্যাডার
- প্রশাসন
- পুলিশ
- নিরীক্ষা ও হিসাব
- আনসার
- পরিবার পরিকল্পনা
- শুল্ক ও আবগারি
- সমবায়
- পররাষ্ট্র
- তথ্য
- খাদ্য
- রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক
- ডাক
- বাণিজ্য
- কর
বিসিএস কারিগরি/পেশাগত
- গণপূর্ত
- জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী
- সড়ক ও জনপদ
- স্বাস্থ্য
- বন
- পশু সম্পদ
- রেলওয়ে প্রকৌশল
- পরিসংখ্যান
- মৎস্য
- কৃষি
- কারিগরি শিক্ষা
- সাধারণ শিক্ষা
বিসিএস নিয়োগ প্রক্রিয়া
বিসিএস বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগীতামূলক পরিক্ষা হিসেবে ধরা হয়। গড়ে প্রতি বছর ৪,০০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ পরিক্ষার্থী এই পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করে! এই সংখ্যা ছোট করে দেখলে হবেনা। জেনে অবাক হবেন এক বছরের মোট চাকরি প্রার্থীর প্রায় ৯০% শতাংশই বিসিএসে ফাইট করে!

এখানে সাফল্যের পারসেন্টেজ যদি চিন্তা করেন তাহলে মোট পরিক্ষার্থীর মাত্র ০.০২% সফল হয়! অনেক কম। কিন্তু সেই তুলনায় অনেক বেশি প্রতিযোগীতা। এই পরিক্ষাটি তিনটি ধাপে নেয়া হয়। যথা,
- প্রাথমিক পরিক্ষা
- লিখিত পরিক্ষা
- মৌখিক পরিক্ষা বা ইন্টারভিউ
ধাপে ধাপে এই পরিক্ষাগুলোর কার্যক্রম বলছি,
প্রথম ধাপ (প্রাথমিক পরিক্ষা)
বিসিএস পরিক্ষার প্রথম ধাপ হলো প্রাথমিক পরিক্ষা। এই পরিক্ষায় শর্ট প্রশ্ন বা অবজেক্টিভ প্রশ্নের মাধ্যমে পরিক্ষা নেয়া হয়। সাধারণত এই পরিক্ষাটি বছরের মে বা জুনের আশেপাশে হয়ে থাকে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে সব এলেমেলো হয়ে গিয়েছে এই বছর।
দ্বিতীয় ধাপ (লিখিত পরিক্ষা)
এটাই প্রধান পরিক্ষা। এই পরিক্ষাটি বছরের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের আশেপাশে হয়ে থাকে। তবে করোনা পরিস্থির কারণে অনেক কিছুর মতো এসবের হিসাব নিকাশও কিছুটা পাল্টে গিয়েছে।

তবে সামনের দিকে আশা করা যায় ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
তৃতীয় এবং চূড়ান্ত ধাপ (ইন্টারভিউ বা মৌখিক পরিক্ষা)
লিখিত পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবার কয়েক মাসের মধ্যে ভাইবা/ইন্টারভিউ/মৌখিক পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এটাই বিসিএসের চূড়ান্ত পরিক্ষা। এই পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে উনি ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
পরিক্ষার্থীর যোগ্যতা
বিসিএসে যারা আবেদনের যোগ্য তারা হলেন,
- অনার্স পাশ হতে হবে।
- কেউ যদি তিন বছরের অনার্স বা পাস কোর্সে পড়েন তাকে অবশ্যই মাস্টার্স পাশ হতে হবে।
- শিক্ষা জীবনে একের অধিক পরিক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি থাকতে পারবেনা।
নাম্বার বন্টন

যে তিনটি ধাপে পরিক্ষা হয় সেই তিন ধাপের নাম্বার বন্টন নিম্নে দেয়া হলো,
প্রাথমিক বা প্রিলিমিনারি পরিক্ষা
[table id=2 /]
লিখিত পরিক্ষা
সাধারণ ক্যাডার এবং প্রফেশনাল ক্যাডারের লিখিত পরিক্ষার বিষয় এবং মান বন্টনে একটু পার্থক্য আছে। সেটা নিচের টেবিল থেকে দেখে নিন,
সাধারণ ক্যাডার লিখিত পরিক্ষার মানবন্টনঃ
[table id=3 /]
প্রফেশনাল ক্যাডার লিখিত পরিক্ষার মানবন্টনঃ
[table id=4 /]
উভয় ক্যাডারে আবেদন করলেঃ
কেউ উভয় ক্যাডারে আবেদন করলে তাকে ৯টি আবশ্যিক বিষয় এবং ২টি পদ সম্পর্কীত বিষয়ের উপর পরিক্ষা দিতে হয়।
মৌখিক/ভাইবা/ইন্টারভিউ
লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণদের ভাইবার জন্য যোগ্য ধরা হয়। ভাইবাতে ২০০ মার্কস বরাদ্দ। তবে এই ধাপে সাফল্যের হার খুবই কম।
চূড়ান্ত নির্বাচন
ভাইবায় উত্তীর্ণ হলে পিএসসি যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সুপারিশ করে।

এরপর মন্ত্রণালয় পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কতৃক স্বাস্থ পরিক্ষা, এনএসআই ভেরিফিকেশন এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে তাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এই প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক সময় লাগে। প্রায় এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে।
সিভিল সার্ভিস কেন বেছে নিবেন?
সিভিল সার্ভিসের জন্য অনেকে ট্রেন্ডের সাথে গা ভাসিয়ে দেন। উনারা জানেনওনা কেন সিভিল সার্ভিসের পরিক্ষা দিচ্ছেন। আমি এখন এটাই বলবো যে কেন আপনি সিভিল সার্ভিসের জন্য পরিক্ষা দিবেন।

সিভিল সার্ভিস বেছে নিবেন কারণ,
- এখানে সাধারণ মানুষ এবং দেশের সেবা করার সুযোগ পাওয়া যায়। তাই সৎ থাকবেন।
- বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া চাকরিচ্যুত হবার ভয় না থাকায় এই জবের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে। অর্থাৎ চাকরির নিরাপত্তা আছে।
- পাঁচ বছরের শিক্ষা ছুটি নেয়া যায়। তাই বলা যায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেশি।
- বেতন এবং সুযোগ সুবিধা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
- চাকরির মেয়াদ শেষে রয়েছে বিশাল পেনশনের সুবিধা।
- পাঁচ বছরের জন্য লিয়েন নেয়ার সুবিধা আছে।
- দাপ্তরিক এবং প্রশিক্ষণ কাজে বিদেশ সফর করার সুযোগ রয়েছে।
- সামাজিক মর্যাদা।
- রাষ্ট্রের পরিচালনা কাজে সরকারের সাথে সরাসরি অংশ নেয়া যায়।
- গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে কাজ করার সুবিধা এবং পরিচিতি বাড়ানোর সুবিধা।
উপর্যুক্ত সুবিধাগুলোই মূলত এই জবের মূল আকর্ষণ। এ ছাড়াও অনেকের অনেক ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে এটাকে পছন্দ করেন। আপনি কি কারণে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে চান সেটা জানাতে পারেন মন্তব্য অংশে।
নবনিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস কর্মকর্তার বেতন
এটা অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রতে থাকে। তাই ভাবলাম একটু করে এই ব্যাপারে একটু বলে নেই।

জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী,
- নবম গ্রেডে কোনো কর্মকর্তা যোগদান করলে তার মূল বেতন ২২,০০০ টাকা এবং মূল বেতনের ৫% ইনক্রিমেন্টসহ তার মূল বেতন দাঁড়ায় ২৩,১০০ টাকায়।
- ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকাতে নিয়োগ হলে মূল বেতনের ৫৫% হারে নূন্যতম ৯৬০০ টাকা, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন অথবা সাভার পৌর এলাকায় নিয়োগ হলে মূল বেতনের ৪৫% হারে নূন্যতম ৮০০০ টাকা,আর অন্যান্য জেলা, উপজেলায় হলে মূল বেতনের ৪০% হারে নূন্যতম ৭০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া পাবেন।
- প্রতি মাসে ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পাবেন।
- প্রতি মাসে এক সন্তানের জন্য ৫০০ টাকা, দুই সন্তানের জন্য ১০০০ টাকা শিক্ষা ভাতা পাবেন। দুইয়ের অধিক সন্তান থাকলেও ১০০০ টাকাই পাবেন আর সন্তান না থাকলে কোনো টাকা পাবেন না
এখন আপনিই একটা আনুমানিক হিসাব করে নিন। এটাই শেষ নয়। শুধু বেসিক একটা ধারণা দিলাম এখানে।
কিভাবে প্রস্তুতি নিবেন?
এই পরিক্ষার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। এক কথায় প্রচুর খাটতে হবে। তবে সারাদিন শুধু খেটে গেলেই হবেনা। স্মার্টলি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারলে পরিশ্রম অনুযায়ী ভালো ফলাফল পাবেন।

নিম্নে, নিজেকে যেভাবে প্রস্তুত করতে পারেন সেটার একটা গাইডলাইন দেয়ার চেষ্টা করলাম,
- সবার আগে এই পরিক্ষার সিলেবাস নিয়ে ধারণা নিতে হবে। উপরে আমি যেভাবে দিয়েছি সেটা বেসিক ধারণা। আপনাকে আরো খোঁজাখুঁজি করতে হবে, ঘাটতে হবে। কখনো এক লেখায় সবকিছু পাবেন না।
- অবশ্যই প্রশ্নব্যাংক যোগাড় করে সেটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘাটবেন। তাহলে ধারণা আরো পোক্ত হবে।
- বিসিএসে রেজাল্ট খুব বড় এফেক্ট করেনা। তাও সিজিপিএ কমপক্ষে ৩ এর উপর রাখতে চেষ্টা করুন। ভাইবাতে কাজে দিবে হয়তো।
- কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছেন তা ম্যাটার করেনা। আপনাকে বাছাই করা হবে, বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানকে নয়। তাই এ ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
- বাছাই করে ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত বোর্ড বইগুলো পড়ে ফেলবেন। এগুলোই তো বেসিক! বেসিক দূর্বল মানে সবই নষ্ট।
- কিছু বই পড়ে রাখবেন। যেমন, অসমাপ্ত আত্মজীবনী(শেখ মুজিবুর রহমান), বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫-১৯৭১ (ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন), লাল নীল দীপাবলি (ড. হুমায়ূন আজাদ), বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর (ড. তারেক শামসুর রহমান) ইত্যাদি।
- বিভিন্ন ভালো গাইড বই।
- চেষ্টা করবেন লিখিত পরিক্ষার জন্য প্রথম থেকেই পড়তে। এটা আপনার বেসিককে স্ট্রং করবে। যেটা প্রিলিমিনারি এবং ভাইবাতেও কাজে লাগবে!
- যেটাতে দূর্বলতা বেশি সেটা আগে শেষ করুন।
- ইংরেজি ভোকাবুলারি পড়ুন বেশি করে।
- যাই পড়বেন, তাড়াহুড়া করবেন না। বুঝে বুঝে পড়ুন।
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, বেশি বেশি পরিক্ষা দিন নিজে নিজে! এটা কতটুকু কাজে লাগে ধীরে ধীরে বুঝবেন।
আজকে এতোটুকুই। আশা করি লেখাটা আপনার কাজে লাগবে।
আমাদের আরো লেখা পড়ুন-
- মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং এর গুরুত্ব
- প্রসেসর সম্পর্কে বিস্তারিত
- এস ই ও কি এবং কেন?
- সেন্টমার্টিন ভ্রমণ খরচ এবং বিস্তারিত সব তথ্য
- কাপ্তাই কায়াকিং করতে কিভাবে যাবেন এবং খরচ কত?
ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।